আয়েশা বেগম তাঁর সংসারের যাবতীয় কাজের ফাঁকে বাড়িতে একটি হাঁস-মুরগির খামার গড়ে তুলেছেন । এই খামার থেকে সারা বছরই কমবেশি ডিম উৎপাদিত হয়। এক বছর পর সরকারি মাছের খামার দেখতে যান আয়েশা এবং এর পর থেকে তাঁর মাথায় হাঁস-মুরগির খামারের পাশাপাশি মাছ চাষ করার আগ্রহ জাগে। এক বছরে হাঁস-মুরগির খামার থেকে ডিম বিক্রির নিট আয় বিশ হাজার টাকা দিয়ে তিনি বাড়ির পাশে ২ বিঘা জমিতে পুকুর করে বিভিন্ন জাতের মাছ চাষ শুরু করেন । দুটি খামারে নতুন করে কয়েকজন শ্রমিক নিয়োগ পায় । হাঁস-মুরগির খামার থেকে ডিম বিক্রি এবং এক বছর পরে পুকুরের মাছ বিক্রি শুরু হলে আয়েশার উপার্জন বাড়তে থাকে । তিনজন সন্তানের পড়াশোনার খরচ এবং সংসারের অন্যান্য যাবতীয় খরচ মিটিয়ে আয়েশার সঞ্চয়ও বাড়তে থাকে । আয়েশার মাছ ও হাঁস-মুরগির খামারের কাজকর্ম বৃদ্ধি পাওয়ায় তাঁর স্বামী রহমত আলী শহরের চাকরি ত্যাগ করে গ্রামে স্ত্রীর খামারে যোগ দেন। উভয়ের প্রচেষ্টায় তাঁরা বেশ কিছু জমি, হাঁস-মুরগি এবং মাছ চাষের আওতায় নিয়ে আসেন । ১২ জন নারী-পুরুষ শ্রমিকও নিয়োগ করেন । প্রত্যেক শ্রমিকের কাজও বুঝিয়ে দেন তাঁরা। আয়েশা এবং রহমত পালাক্রমে শ্রমিক কর্মচারী এবং খামারসমূহ তদারক করেন । ডিম ও মাছ বাজারজাত করে বেচা-কেনার ব্যবস্থাও করেন তাঁরা । তাদের সাফল্য দেখে গ্রামের অনেকে তাঁদের অনুসরণ করে গ্রাম ও এলাকা জুড়ে হাঁস-মুরগির খামার এবং মাছ চাষ শুরু করেন । ডিম ও মাছ নেওয়ার জন্য বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকার নিয়মিত আসে আয়েশার গ্রামে । কয়েক বছরে এলাকাটি কৃষি, হাঁস-মুরগির খামার ও মাছ চাষাবাদ করে অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জন করে । এলাকায় এখন ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে হাঁস-মুরগি ও মাছ উৎপাদন করা যায় ।
আমরা কি বলতে পারি যে আয়েশা বেগম একজন সংগঠক? তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতা কি বিকাশ লাভ করেছে?
উপরের আলোচনা থেকে আমরা নিশ্চিত যে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে উৎপাদনমুখী কার্যক্রম পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করাকে সংগঠন বলে । সত্যিকার অর্থে সংগঠন ছাড়া উৎপাদন ও ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যবস্থাপনা প্রায় অসম্ভব। আধুনিক বিশ্বে উৎপাদন কর্মকাণ্ডে বিভিন্ন জন বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন । এ দায়িত্ব সংগঠক দক্ষতার সাথে যোগ্যতা অনুযায়ী ভাগ করে দেন । এভাবে কর্মীদের সহায়তায় উৎপাদন ও ব্যবসায়ের বিভিন্ন কার্যবলি সম্পাদিত হয়। কিন্তু এই কার্য সম্পাদনে কর্মীদের মধ্যে একটি পারস্পরিক অধিকার ও দায়িত্ব সৃষ্টি হয়। পারস্পরিক এই অধিকার ও দায়িত্ব কাঠামোই সংগঠন । সুতরাং সংগঠন হচ্ছে ব্যবসায়ের ভিত্তি ।
সংগঠনের বিভিন্ন অংশ একসঙ্গে ধরে রাখা এবং লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় রূপরেখা তৈরি সাংগঠনিক কাঠামোর কাজ । তাছাড়া বিভিন্ন কাজের দায়িত্ব বণ্টন, নিয়ম-শৃঙ্খলা গড়ে তোলা ইত্যাদি সাংগঠনিক কাঠামোর অন্তর্গত । ব্যবসায়ের আয়তন, উৎপাদিত পণ্যের প্রকৃতি ও পরিমাণ, শিল্পের প্রকৃতি, উৎপাদন প্রক্রিয়া, শ্রমিকের দক্ষতা প্রভৃতির উপর ব্যবসায়ের সাংগঠনিক কাঠামো নির্ভরশীল । সংগঠনের প্রধান সমস্যা হচ্ছে সম্মিলিত উৎপাদন অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে উৎপাদনের বা আয়ের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা। তা না হলে কোনো সামাজিক সংগঠনই টেকসই হয় না ।
ব্যবসায়ের সাংগঠনিক কাঠামোর বিভিন্ন বিভাগ, উপবিভাগ ও শাখার কাজকর্ম নির্দিষ্ট করে ভারপ্রাপ্ত উর্ধ্বতন ও অধস্তন কর্মীদের পদগুলো ক্রমানুসারে সাজালে তা হতে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কাঠামোর যে সুস্পষ্ট চিত্র পাওয়া যায় তাকে সংগঠনের চিত্র বলে। সংগঠন ব্যবস্থাপনা যত সুন্দর ও সুষ্ঠু হবে ব্যবসায়ের সাফল্য তত বেশি হবে । সুতরাং সংগঠনই হলো ব্যবসায়ের বা যে কোন সামাজিক উৎপাদনের মৌলিক ও প্রধান বিষয় । কাজ : সাংগঠনিক কাজের একটি তালিকা তৈরি কর ।
একটি ভালো সংগঠনের কতগুলো প্রবণতা বা বৈশিষ্ট্য থাকে । তা হচ্ছে-
১. ব্যবসায়ের উদ্দেশ্য ও প্রকৃতি : সংগঠনের প্রথম ধাপে ব্যবসায়ের উদ্দেশ্য কী হবে তা নির্ধারণ করতে হয় । ব্যবসায়ের উদ্দেশ্য ও প্রকৃতি অনুসারে ব্যবসায়ের সাংগঠনিক রূপ তৈরি করতে হয় । এই উদ্দেশ্যসমূহের মধ্যে কোনটি মুখ্য, কোনটি গৌণ, কোনটি স্বল্পমেয়াদি এবং কোনটি দীর্ঘমেয়াদি তা নির্ধারণ করে নিতে হয় ।
২. ব্যবসায়ের কার্যাবলি নির্ধারণ : ব্যবসায়ের উদ্দেশ্য ও প্রকৃতি ঠিকমতো নির্ধারণ করার পর ব্যবসায়ের সমগ্র কার্যাবলি বিশ্লেষণ করা হয় । যেমন, উৎপাদন, ক্রয়-বিক্রয়, অর্থসংস্থান, শ্রমিক-কর্মী নিয়োগ, শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক প্রভৃতি। সে জন্য প্রয়োজন হয় হিসাবরক্ষণ, বিজ্ঞাপন ও প্রচার, পণ্য মজুদ, ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি ।
৩. কার্যাবলির বিভাগ : কার্যাবলি বিশ্লেষণের পর কাজের ধরন ও উদ্দেশ্যের মিল অনুযায়ী কাজগুলোকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা হয়। একই বিভাগের সহায়ক কাজগুলোকে আবার উপবিভাগে ভাগ করা হয় । যেমন, উৎপাদন বিভাগ, ক্রয় বিভাগ, বিক্রয় বিভাগ, হিসাবরক্ষণ বিভাগ, প্রচার বিভাগ ইত্যাদি । অনেক সময় কোনো কোনো ব্যবসা আঞ্চলিক ভিত্তিতেও ভাগ করা হয় । কয়েকটি শাখা একত্রে আঞ্চলিক বিভাগ হিসাবে গণ্য হয় ।
৪. কর্তব্য বণ্টন : ব্যবসায়ের প্রতিটি কর্মীর উপর একটি নির্দিষ্ট কাজের ভার অর্পণ করা হয় । অভিজ্ঞতা, ক্ষমতা ও দক্ষতা অনুসারে প্রতিটি বিভাগে ও উপবিভাগের প্রতিটি কর্মীর সুনির্দিষ্ট কর্তব্য স্থির করা হয় এবং যে কর্মী যে কাজে অভিজ্ঞ ও দক্ষ, তাকে সেই কাজই দেওয়া হয় ।
৫. অধিকার ও ভার বণ্টন : ভার অর্পণ বলতে কর্তব্য পালনের উপযুক্ত কার্যনির্বাহী ক্ষমতা অর্পণ করাকে বোঝায় । প্রতিটি কর্মীকে স্বাধীনভাবে, নির্বিঘ্নে এবং যথাযথভাবে কাজ করার অধিকার দিতে হয়। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাঁর কর্তৃত্ব বা ক্ষমতার একাংশ তাঁর অধস্তন কর্মীকে অর্পণ করেন । আবার অধস্তন কর্মী তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নিকট কাজের কৈফিয়ত দিতে বাধ্য থাকেন। উপর থেকে নিচে এবং নিচ থেকে উপরে এই দুটি ভিন্নমুখী প্রবাহ অব্যাহত থাকলে সংগঠন সফল হয়।
আরও দেখুন...